পটভূমি ও ইতিহাস

সুফি সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহঃ) এর অবদান এবং এর বর্তমান গতিধারা

দেওয়ানবাগ শরীফ সুফিবাদের আদর্শে গভীরভাবে প্রোথিত একটি অন্যতম প্রধান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। শ্রদ্ধেয় সুফি সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা (রহঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই দরবার শরীফের মূল লক্ষ্য ছিল মোহাম্মদী ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী প্রচার করা। এর মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, ত্যাগ, ক্ষমা এবং দয়ার মতো ঐশী আদর্শের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জে এর কার্যক্রম শুরু হলেও, এটি বর্তমানে একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে, যা এখন ঢাকার কেন্দ্রীয় কেন্দ্র থেকে বর্তমান নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই নিবন্ধে প্রতিষ্ঠাতার অসাধারণ প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস এবং বর্তমান পরিচালকের পরিচয় তুলে ধরা হবে, যিনি এই প্রতিষ্ঠানের চলমান লক্ষ্য বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

 

প্রতিষ্ঠাতা: সুফি সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা (রহঃ) দেওয়ানবাগ শরীফের উৎপত্তির ইতিহাস এর প্রতিষ্ঠাতা সুফি সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা (রহঃ)-এর জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি ১৯৪৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ কয়েক শতাব্দী পূর্বে সৌদি আরবের মদিনা থেকে কাতার হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন এবং তাঁর বংশধারা সরাসরি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে সম্পর্কিত। তিনি ছিলেন মরহুম আলহাজ সৈয়দ আব্দুর রশিদ সরকার (রহঃ) এবং হযরত সৈয়দা জোবেদা খাতুন (রহঃ)-এর পুত্র।

 

তাঁর শিক্ষাজীবনের প্রথম দিকটা ইসলামী জ্ঞান অর্জনে নিবেদিত ছিল। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তিনি স্বনামধন্য তালশহর করিমিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি কেবল সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেননি, বরং ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সহজাত নেতৃত্বগুণেরও পরিচয় দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেন এবং দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি গভীর অঙ্গীকার প্রদর্শন করেন। যুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পবিত্র কুরআন ও হাদিসের ওপর ব্যাপক গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি ইসলামী গ্রন্থাবলির একজন বিচক্ষণ ব্যাখ্যাকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহঃ)-এর মুরিদ হওয়া ছিল তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। নিজ মুর্শিদের নির্দেশনায় তিনি সামরিক জীবন ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক সাধনায় সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর গভীর আধ্যাত্মিক যোগাযোগ ও উন্নতি তাঁকে প্রধান খলিফার পদে অধিষ্ঠিত করে এবং তরিকা পরিচালনা ও দরবার শরীফের ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়। এই আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের চূড়ান্ত পরিণতিতে ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫ (মোতাবেক ১০ মহররম, ১৪০৬ হিজরি) তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়ানবাগ শরীফ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে নারায়ণগঞ্জের দেওয়ানবাগে অবস্থিত হলেও, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হয় এবং অবশেষে ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত বাবে রহমত, দেওয়ানবাগ শরীফে এর কেন্দ্রীয় কার্যক্রম সুসংহত হয়, যা এখন এর বিশ্বব্যাপী কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করছে।

babe barkat

সুফি সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহঃ) তাঁর জীবনব্যাপী গভীর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি, অসাধারণ প্রজ্ঞা এবং ইসলামের প্রকৃত রূপ পুনঃপ্রতিষ্ঠার অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ছিলেন। তিনি সতর্কতার সাথে এমন অনেক অনুশীলন চিহ্নিত করেছিলেন যা তাঁর বিশ্বাসমতে চৌদ্দ শতাব্দী ধরে মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়েছিল এবং সেগুলি সংশোধনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছিলেন। উল্লেখ্য, তাঁর প্রস্তাবিত কিছু ধর্মীয় সংস্কার বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে এবং বাস্তবায়িত হয়েছিল বলে জানা যায়। তাঁর गरिमामয় চরিত্র এবং দূরদর্শী ধর্মীয় দর্শন বিশ্বব্যাপী বহু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক, ধর্মীয় পণ্ডিত এবং বুদ্ধিজীবীর মনে গভীরভাবে সাড়া ফেলেছিল। সুফি সম্রাট হুজুর ক্বেবলাজান ২৭ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে ইন্তেকাল করেন, রেখে যান বিশ্বব্যাপী এক বিশাল অনুসারীমণ্ডলী।

baber morshed night

দেওয়ানবাগ শরীফের শিক্ষা ও বিশ্বব্যাপী প্রভাব দেওয়ানবাগ শরীফ মূলতঃ মোহাম্মদী ইসলামের নীতিমালা প্রচারে নিবেদিত, যা ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং সামষ্টিক সামাজিক সম্প্রীতির জন্য অপরিহার্য সার্বজনীন মূল্যবোধের ওপর গুরুত্বারোপ করে। এই প্রতিষ্ঠান শান্তি, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, ত্যাগ, ক্ষমা এবং দয়ার মতো ঐশী আদর্শ বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং এগুলিকে আল্লাহ কর্তৃক তাঁর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মাধ্যমে প্রদত্ত নাজাতের পথ হিসেবে বিবেচনা করে।

দেওয়ানবাগ শরীফ আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য একটি সুস্পষ্ট কাঠামো প্রদান করে, যা চারটি মৌলিক শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে গঠিত: আত্মশুদ্ধি, ক্বালব বা দিল জিন্দা করা, নামাজে হুজুরি এবং রাসুল (সাঃ)-এর প্রেমিক হওয়ার সাধনা (আশেকে রাসুল হওয়া)। এই শিক্ষাগুলো আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক গভীর করতে চাওয়া মুরিদানদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক পথনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে।

দেওয়ানবাগ শরীফের প্রভাব আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত, ১৩২টি দেশে ১১টি প্রধান দরবার শরীফ এবং কয়েকশ সংশ্লিষ্ট খানকা ও জাকের মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো আধ্যাত্মিক সাধকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাস্থল হিসেবে কাজ করে, যা সুফি সম্রাট হুজুর ক্বেবলাজান কর্তৃক নির্ধারিত দৈনন্দিন আধ্যাত্মিক অনুশীলন বা ওয়াজিফার নিয়মিত পালনে সহায়তা করে। বার্ষিক আশেকে রাসুল (সাঃ) সম্মেলন একটি প্রধান আয়োজন, যা আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা পেতে আসা লক্ষ লক্ষ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ভক্তদের আকর্ষণ করে। এছাড়াও, দেওয়ানবাগ শরীফ থেকে প্রকাশিত ধর্মীয় সাহিত্য সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, যা ধর্মপ্রাণ অনুসারীদের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষাগুলোকে পরিপুষ্ট করে।

বর্তমান নেতৃত্ব: মিশনের ধারাবাহিকতা এর শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠাতার ইন্তেকালের পর, দেওয়ানবাগ শরীফের নেতৃত্ব তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.)-এর ওপর অর্পণ করা হয়েছে। সুফি সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা (রহঃ) কর্তৃক তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে প্রস্তুতকৃত ওসিয়তনামা অনুসারে, ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.) মোহাম্মদী ইসলাম আন্দোলনের নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.) এখন এই প্রতিষ্ঠান এবং এর অগণিত অনুসারীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন, সুফি সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহঃ) কর্তৃক সমর্থিত মোহাম্মদী ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের অব্যাহত প্রচার ও অনুশীলন নিশ্চিত করছেন। তাঁর নেতৃত্ব আধ্যাত্মিক পরম্পরার ধারাবাহিকতা এবং যে মৌলিক নীতিগুলোর ওপর দেওয়ানবাগ শরীফ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলোর প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করে।

3

উপসংহার: দেওয়ানবাগ শরীফ সুফি সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা (রহঃ)-এর স্থায়ী অবদানের এক উজ্জ্বল সাক্ষ্য। গভীর ধর্মীয় পাণ্ডিত্য, নিবেদিত আধ্যাত্মিক সাধনা এবং মোহাম্মদী ইসলাম প্রচারে অটল অঙ্গীকারে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত তাঁর জীবন বিশ্বব্যাপী অগণিত মানুষের ওপর এক অমোচনীয় প্রভাব ফেলেছে। বর্তমান পরিচালক, ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.)-এর তত্ত্বাবধানে দেওয়ানবাগ শরীফ তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ অব্যাহত রেখেছে, ব্যক্তিদের তাদের আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করছে এবং বিশ্বজুড়ে শান্তি, সম্প্রীতি ও দয়ার সার্বজনীন মূল্যবোধ সক্রিয়ভাবে প্রচার করছে।